প্রকাশিত হয়েছে একুশে টিভি অনলাইন পোর্টালে | প্রকাশিত : ১৬:২১, ২৮ মে ২০১৯ | আপডেট: ১৭:২৩, ১ জুন ২০১৯
রাজশাহী শহর থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরে বাঘা উপজেলার বাউসা মিয়াপাড়া গ্রামে জন্ম মীর রাসেল আহমেদের। ঠিক কবে সে জন্মগ্রহণ করেছে তা তার বাবা-মা কেউ ঠিক করে বলতে পারেন না। মা শুধু বলতে পারেন তার জন্ম ফাল্গুন মাসের ২১ বা ২২ তারিখ হবে হয়তো। বাবা-মা দু’জনেরই অক্ষর জ্ঞান নেই। বাবার গ্রাম্য ব্যবসাতেই চলতো নিম্ন মধ্যবিত্ত পরিবারের। রাসেলের বাবা-মা পড়ালেখা না জানায় চাচার কাছে সে হাতে খড়ি নিয়েছে।
ছোট বেলায় গ্রামের একটি স্কুলে ভর্তি হয় রাসেল। এ বিষয়ে কথা বলতে গিয়ে রাসেল বলেন, ‘যতটুকু মনে পড়ে বাবা-মা কোনোদিন আমাকে পড়তে বসতে বলেননি। নিজের ইচ্ছাতেই পড়তে বসতাম, নিয়মিত স্কুলে যেতাম। প্রতিবারই স্কুলে ৩য় কিংবা ৪র্থ হতাম। যার কারণে বাবা-মার একটা বিশ্বাস আর আশা জন্মেছিল আমার উপরে।’
দেশে প্রথমবারের মত ২০০৫ সালে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা অনুষ্ঠিত হয়। সেখানে সে অংশগ্রহণ করে। ফলাফল প্রকাশিত হওয়ার পর দেখা যায় জিপিএ ৫ পেয়েছে রাসেল। কিছু দিন পরে বৃত্তির ফলাফলেও দেখা যায় ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায়ছে সে। এর পর হাই স্কুলে ভর্তি হন। আর অষ্টম শ্রেণীতে ট্যালেন্টপুলে বৃত্তি পায় সে। তারপর এসএসসি পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে সেখানেও তুলে নেন জিপিএ ৫। এবার তার কলেজে ভর্তি হওয়ার পালা। তার ইচ্ছে ছিলো ভালো কলেজে পড়বে। স্বপ্ন ছিলো রাজশাহী কলেজে ভর্তি হবে। কিন্তু বাবা তাকে রাজশাহী পড়াবেন না। কারণ তার চিন্তা তিনি ঠিকমত খরচ বহন করতে পারবেন না। এরপর সে পরিবারকে ম্যানেজ করে ভর্তি হয় রাজশাহী কলেজে। প্রথমবারের মত বাবা-মাকে ছেড়ে শহরে যাত্রা শুরু হয় রাসেলের।
রাসেল বলেন, ‘২০১১ সালে কলেজ ভর্তি হওয়ার পর রাজশাহী শহরে অনেক সংগ্রাম করেছি। মেসে থাকতাম। খাবার ভালো ছিলো না, ঠিকমত খাবার পেতাম না। একবার ডায়রিয়া হয়ে রাজশাহী মেডিকেলের বারান্দায় শুয়ে ছিলাম ৭ দিন। মৃত্যুর খুব কাছ থেকে ঘুরে এসেছি। বিষয়টি মনে পড়লে এখনোও ভয়ে থমকে উঠি।’
তিনি বলেন, ‘কলেজে ভর্তি হওয়ার পরে স্বপ্ন হয়েছিলো বুয়েটে পড়বো। সে হিসেবেই আগাচ্ছিলাম। কিন্তু অধিক পরিমাণ ইন্টারনেট আসক্তি আমার অবস্থান থেকে দূরে ঠেলে দেয়। ২০১১-১২ সালে প্রতিদিন গড়ে ১১-১২ ঘণ্টা ইন্টারনেট ব্যবহার করতাম। একটার পর একটা গুগল করতাম, কারণে কিংবা অকারণে। কলেজে শিক্ষকদের কোনো প্রশ্ন করতাম না, যা করার গুগলকেই করতাম।
রাসেল বলেন, ‘নিয়মিত পত্রিকা পড়তাম। পত্রিকা মারফত জানলাম গ্রামীণফোন-প্রথম আলো ইন্টারনেট উৎসব হবে। সেবার বাঘাতে উৎসব হয়েছিলো। আমার গ্রামের বাড়ি থেকে ১২ কিলোমিটার দক্ষিণে। অনেক আশা আর উৎসাহ নিয়ে রাজশাহী থেকে বাঘায় যাই। অনেক জটিলতা শেষ করে সুযোগ পাই ইন্টারনেট উৎসবে অংশ নেওয়ার। ১০-১২ ঘণ্টা করে ইন্টারনেট ব্রাউজিং বৃথা হলো না! নির্বাচিত হলাম রাজশাহীর আইজিনিয়াস হিসেবে। প্রথম আলোতে সে সময় ছবি ছাপা হয়েছিলো। এরপরে ২০১২ সালেও রাজশাহীতে ইন্টারনেট উৎসব হয়। তখনও দ্বিতীয় বারের মত রাজশাহী থেকে আইজিনিয়াস নির্বাচিত হয়েছিলাম।’
এর পর এইচএসসির ফলাফল প্রকাশিত হয় রাসেলের। একটি বিষয় ছাড়া অন্য সবগুলোতে এ + পায় সে। বুয়েটে পড়ার লালিত স্বপ্নটা সেখানেই ভেঙ্গে যায় তার। ভর্তি হওয়া ইঞ্জিনিয়ারিং কোচিং ছেড়ে দেয় সে। এবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের আইআইটি বিভাগের জন্য প্রস্তুতি নিতে থাকে রাসেল।
২০১৪ সালে প্রথমবারের মত ঢাকায় পাড়ি জমায় সে। কিন্তু ঢাবিতে সুযোগ হয়নি। ভর্তির সুযোগ পায় জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগে। বর্তমানে এই বিভাগেয় মাস্টার্সের শিক্ষার্থী রাসেল। শুধু একাডেমিক পড়াশুনায় ব্যাস্ত থাকেনি সে, তথ্য ও প্রযুক্তি নিয়ে রাসেল সবসময়ই অনেক বেশি উৎসাহী ছিলো।
রাসেল এখন বিশ্বের অন্যতম বড় ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান চীনের আলিবাবা গ্রুপের ডিজিটাল স্পেশালিস্ট হিসেবে কর্মরত রয়েছেন। শুধু তাই নয়, সে ইউসি ব্রাউজারের কার্যক্রমের প্রথম থেকেই ইউসি ব্রাউজারের বাংলাদেশের ব্রান্ড এম্বাসেডর হিসেবেও কাজ করে আসছেন।
তথ্য প্রযুক্তি যে মানুষের জীবনকে সহজ করে দিয়েছে তার অনন্য উদাহরণ রাসেল। শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের সুবিধা করতে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইতোমধ্যে তার মাধ্যমে চালু হয়েছে এ্যাপসের মাধ্যমে সাইকেল শেয়ারিং সিস্টেম জো-বাইক। ছেলে-মেয়ে উভয়ের ব্যবহার উপযোগী স্মার্ট বাইসাইকেল জো-বাইকে এ্যাপসের মাধ্যমে অত্যাধুনিক লক, সোলার প্যানেল, জিপিএস সিস্টেম ইত্যাদি রয়েছে।
এসব সাইকেলের লক খোলার জন্য দরকার হয় একটি অ্যান্ড্রয়েড অ্যাপ। অ্যাপ ডাউনলোড করে, অ্যাকাউন্ট খুলে সাইকেলের সঙ্গে থাকা কিউআর কোড স্ক্যান করে সাইকেলটি ব্যবহার করা যায়। জো-বাইকের ক্যাম্পাস লিড হিসেবে দায়িত্বে রয়েছেন রাসেল।
রাসেল একুশে টিভি অনলাইনকে জানান, সে কখনোও সময় অপচয় করেনি। ২০০৬ সাল থেকে ২০১০ সাল পর্যন্ত কেটেছে রেডিও, পত্রিকা আর আমার রেডিও ক্লাব নিয়ে। রেডিও ক্লাবের সভাপতির দায়িত্বও পালন করেছিলেন রাসেল। এরপর ২০১১ থেকে ১২ সাল পড়াশোনা ছাড়া পুরো সময়টা কেটেছে তার গুগলের সঙ্গে। আর তাইতো সে ২০১৩ সালে রাজশাহীর প্রথম ইন্টারনেট মিডিয়া হিসেবে চালু করেন ‘রাজশাহী এক্সপ্রেস ডট কম’ নামে একটি অনলাইন পত্রিকা। যা এখন রাজশাহী বিভাগ কেন্দ্রিক সর্বাধিক পঠিত অনলাইন পত্রিকা। পাড়ালেখা করা অবস্থায়ই WHM, Cpanel ম্যানেজমেন্ট, ওয়েব ডিজাইন, ওয়ার্ডপ্রেস, ফটোশপ, ইলাস্ট্রেটর, সোশ্যাল মিডিয়া ম্যানেজমেন্টসহ বিভিন্ন ইন্টারনেট ও ডিজিটাল মিডিয়ার কাজ শিখে ফেলেন রাসেল। প্রযুক্তির প্রতি আকর্ষণ ছাড়াও আন্তর্জাতিক মিডিয়ার খবরে ডুবে থাকতেন রাসেল।
রাসেল বলেন, ‘২০০৬ সাল থেকে ২০১১ সাল পর্যন্ত অনেক রেডিও শুনেছি। স্কুল লাইফে দেশি এবং আন্তর্জাতিক অনেক রেডিওর সঙ্গে ভালো সম্পর্ক গড়ে ওঠে আমার। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো, বাংলাদেশ বেতার রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা, বিবিসি বাংলা, ডয়েচে ভেলে জার্মানি, এনএইচকে জাপান, সিআরআই চায়না, রেডিও তেহরান, ভয়েস অফ আমেরিকা। যার কারণে ২০০৯ সালে রাজশাহী বেতারে ‘সেতুবন্ধন’ নামে একটি রেডিও অনুষ্ঠানে উপস্থাপনা করার সুযোগ হয় আমার। ২০১০ সালে সেরা শ্রোতা হিসেবে সাক্ষাৎকার দেওয়ার সুযোগ হয়েছিলো বিবিসি বাংলায়।’
পড়ালেখা করা অবস্থায় এতদূর এগিয়ে যাওয়া রাসেলের জীবনের লক্ষ্য এখন তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে বদলে দেওয়া।
নিজের স্বপ্ন নিয়ে রাসেল বলেন- ‘তখন ক্লাস ফাইভে পড়তাম। সামনে পিএসসি আর বৃত্তি পরীক্ষা। বাড়িতে একটা রেডিও ছিলো। অনেক রেডিও শুনতাম। বিশেষ করে খবর। সেসময় জাতিসংঘের মহাসচিব ছিলেন কফি আনান। তাকে দেখে আমার ইচ্ছে হয়েছিল জাতিসংঘের মহাসচিব হওয়ার। স্কুলে যতবার রচনা এসেছে ‘জীবনের লক্ষ্য’, ততবারই লিখেছি বড় হয়ে জাতিসংঘের মহাসচিব হবো। কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে স্বপ্নও বদলে গেছে। এখন স্বপ্ন দেখি তথ্য-প্রযুক্তির মাধ্যমে বাংলাদেশকে বদলে দিতে। আগামী দিনগুলোতে বাংলাদেশের তথ্য-প্রযুক্তি ক্ষেত্রে একটি গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে চাই।’
এসএ/